কাদিয়ানীদের অমুসলিম বলি কেন
ইসলাম বিশেষ কোনো জাতি বা জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর নাম নয়। হিন্দু ধর্মের মতো (যদি
তাকে ‘ধর্ম’ বলা চলে) শুধু কিছু সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান অথবা বিশেষ কোনো
উপাসনারীতির নামও নয় ইসলাম। হিন্দুদের ধর্মজগত সম্পর্কে যাদের কিছু অবগতি আছে,
তারা জানেন, এ ধর্মে আকিদা-বিশ্বাসের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। যারা
বেদ-উপনিষদ ইত্যাদিকে ঐশী গ্রন্থ বলে বিশ্বাস করে তারা যেমন হিন্দু, যারা
অস্বীকার করে তারাও হিন্দু! সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী মূর্তিপূজকেরা হিন্দু,
মুর্তিপূজার সমালোচক আর্যরাও হিন্দু! একদিকে দেবদেবী ও ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা হিন্দু,
আবার এগুলিকে অস্বীকারকারী নিরেট বস্ত্তবাদীরাও হিন্দু! সময়ের প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক
লীডার পন্ডিত জওহরলাল নেহরু নিজের সম্পর্কে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘হিন্দু ধর্মটা
বড় বেকায়দার জিনিস। কিছুতেই এর পিছু ছাড়া সম্ভব হয় না। আমি ভগবান মানি না,
তবু হিন্দু। কোনো ধর্মেই আমি বিশ্বাস করি না, তবুও আমি হিন্দু! কি আশ্চর্যের
কথা!’
কিন্তু ইসলামধর্ম এর ব্যতিক্রম। মুসলমান হওয়ার জন্য অবশ্যই
সুস্পষ্ট কিছু আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ করা এবং সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা মেনে চলা
একান্ত অপরিহার্য। এ-ছাড়া কেউ কখনো মুসলমান হতে পারবে না, কোনো নবীর সন্তান হলেও
না।
সাথে সাথে ইসলামের এমন কোনো বিষয়ও অস্বীকার করা চলবে না, যা
সন্দেহাতীতভাবে যুগপরম্পরায় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং উম্মতের সাধারণ দ্বীনদার
শ্রেণীও যে সকল বিষয়কে নবীজীর শিক্ষা বলে জানে। ওলামায়ে কেরামের পরিভাষায় এ
ধরণের বিষয়কে ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’ বলা হয়। যেমন, আল্লাহ একমাত্র মাবুদ, তার কোনো
শরীক নেই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল। কেয়ামত ও
আখেরাত সত্য। কোরআন আল্লাহ তাআলার নাযিল করা কিতাব। পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ।
পবিত্র মক্কা নগরীর কাবাঘর হলো মুসলমানদের কেবলা ইত্যাদি। এগুলো এমন বিষয়, ইসলাম
ও তার নবী সম্পর্কে যার সামান্য জানাশোনা আছে, সে-ই নিশ্চিতভাবে জানে যে, নবীজী
উম্মতকে এসকল জিনিস শিক্ষা দিয়েছেন। এতে সন্দেহ পোষণের কোনো অবকাশ নেই। তো
মুসলমান হওয়ার জন্য এজাতীয় বিষয়ের অস্বীকার থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। কেননা এ
ধরনের বিষয় অস্বীকার করার অর্থ হলো সরাসরি নবীজীর তালীম ও হেদায়াতকে অস্বীকার
করা। যার পর ইসলামের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই আর থাকে না।
নবীজী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে সমস্ত বিষয় অকাট্যভাবে প্রমাণিত,
যুগ-পরম্পরায় প্রতিষ্ঠিত এবং একজন সাধারণ মুসলমানের নিকটও যে বিষয়গুলি অজানা
নয়, তেমন একটি বিষয় হলো খতমে নবুওতের আকীদা। অর্থাৎ আমাদের নবীজীর পর আর কোনো
নবী নেই। নতুন করে কোনো নবী আর আসবে না। নবুওতের ধারা নবীজীর উপর এসে চিরতরে
সমাপ্ত হয়ে গেছে -এই আকীদা।
তাওহীদ, রিসালাত, কেয়ামত-আখেরাত, কোরআন
অবতীর্ণ হওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ হওয়া, কাবা শরীফ কেবলা হওয়া ইত্যাদি
বিষয় যে পর্যায়ের অকাট্য ও সন্দেহাতীত দলিল দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত, খতমে
নবুওয়াতের আকীদাও অনুরূপ দলিল দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে সুপ্রমাণিত। নবীজী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টিকে যতবার যত আঙ্গিকে এবং যতটা
সুস্পষ্টভাবে উম্মতকে বলে গেছেন, তারা চে’ স্পষ্ট করে কোনো বিষয় উপস্থাপন করা
সম্ভব নয়।
এজন্যই তাওহীদ, রেসালাত, কেয়ামত-আখেরাত, কোরআন মজীদ, পাঁচ
ওয়াক্ত নামায ইত্যাদির অস্বীকারকারী যেমন স্পষ্ট কাফের, তেমনিভাবে খতমে নবুওতের
আকীদা অস্বীকারকারীও নিঃসন্দেহে কাফের। সিদ্দীকে আকবারের যামানা থেকে আজ পর্যন্ত
উম্মতের সকল সদস্য এ ব্যাপারে একমত যে, নবীজীর পর নতুন নবুওতের দাবী উত্থাপনকারী
এবং সেই দাবী কবুল করে তার উপর ঈমান আনয়নকারী কেউই মুসলমান নয়। যদি কেউ মুসলমান
হওয়ার পর খতমে নবুওত অস্বীকার করে, তাহলে সে ইসলাম থেকে খারেজ হয়ে যাবে
এবং মুরতাদ ও ধর্মদ্রোহী সাব্যস্ত হবে। তার সঙ্গে ধর্মত্যাগী-মুরতাদের আচরণই করা
হবে। ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাস তার সাক্ষী। সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর রা.-এর আমলে
নবুওতের দাবীদার মুসাইলামা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত
কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। যদিও তারা মৌলিকভাবে তাওহীদ ও রেসালাতে বিশ্বাসী
ছিলো। ইতিহাসে পাওয়া যায়, তারা তাদের আযানে ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’
এবং ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’-এ দুটি বাক্যও বলতো। এতদ্বসত্ত্বেও
শুধু নবুওতের দাবী তোলার কারণে সাহাবায়ে কেরাম তাদের বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ
হয়েছেন এবং তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করে ছেড়েছেন। কোনো আপোষ করেননি।
মনে
রাখতে হবে, খতমে নবুওতের এই মাসআলার ভিত্তি শুধু সূরা আহযাবের ৪০ নং আয়াতে
উল্লেখিত ত্রড্ডন্ডব্দ ড্ডপ্সব্ধণ্টল্পল্পব্ধ এর উপরই সীমাবদ্ধ নয়।
বরং এর তাফসীর ও ব্যাখ্যায় প্রায় একশত হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ভাষাগত
কুটিলতার আশ্রয় নিয়ে সরলমনা মুসলমানদেরকে বোকা বানানোর চেষ্টা মেনে নেওয়া যায়
না। আর বাস্তবতা হলো, ত্রড্ডন্ডব্দ শব্দের ‘তা’-এর উপর যবর দিয়ে
‘খাতাম’ (মোহর মেরে বন্ধকারী) পড়া হোক, বা ‘তা’-এর নিচে যের দিয়ে
ত্রড্ডন্ডব্দ ‘খাতিম’ (সুসমাপ্তকারী) পড়া হোক, উভয় অবস্থায় শেষনবীর
মর্মটুকুই অধিকতর স্পষ্ট হয় এবং এর দ্বারা নবীজীর পর আর কোনো নবীর আগমন না
হওয়া, আগমনের সম্ভাবনাও না থাকার আকীদাটিই অধিকতর মজবুত হয়।
সুতরাং
যেমনটা একটু আগে বলা হলো, ত্রড্ডন্ডব্দ ড্ডপ্সব্ধণ্টল্পল্পব্ধ এর
ব্যাখ্যায় একশর মতো হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সঙ্গে রয়েছে উম্মতের যুগযুগের
ইজমা ও ঐক্যমত -এসকল দলিলের কারণে খতমে নবুওতের আকীদা তাওহীদ-রেসালাত,
কেয়মাত-আখেরাত ইত্যাদির মতোই অকাট্য স্বত:সিদ্ধ এবং অখন্ডনীয়। যদি এ বিষয়গুলোর
মাত্র একটি কেউ অস্বীকার করে, যদিও সে কোনো ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে তবু সে
ইসলামের গন্ডি থেকে খারেজ হয়ে যাবে। কেননা যাচ্ছেতাই ব্যাখ্যার ধোঁয়া তুলে এ
জাতীয় আকীদা-বিশ্বাস অস্বীকার করার পরও যদি কারো মুসলমানিত্ব নষ্ট না হয়, তাহলে
বলতে হবে, হিন্দু ধর্মের মতো ইসলামেরও মৌলিক আকিদা-বিশ্বাস এবং জরুরিয়াতে দ্বীন
ইত্যাদির নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা বা হাকীকত নেই। এগুলোতেও যার যেমন ইচ্ছা
হস্তক্ষেপ করার সুযোগ রয়েছে! জানা কথা, বিষয়টা এমন নয়।
এখন প্রশ্ন
হলো, খতমে নবুওতের বিষয়ে কাদিয়ানীদের অবস্থান কী? তারা কি খতমে নবুওতের আকীদা
অস্বীকার করে? এবং বাস্তবেই কি তারা মির্জা গোলাম আহমদকে নবী বলে বিশ্বাস করে? না
কি ‘নবী’ শব্দ বলে অন্য কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে থাকে?
এর উত্তরের জন্য
অনেক বই-পুস্তক ঘাটাঘাটি করার দরকার নেই, অনেক দূরে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই।
মির্জা গোলাম আহমদের পুত্র এবং তার দ্বিতীয় খলীফা মির্জা বশীরুদ্দীন মাহমুদের
শুধু একটি কিতাব ‘হাকীকাতুন নুবুওয়াহ’ পড়াই যথেষ্ট হবে। তিনি কিতাবটি
‘কাদিয়ানী লাহোরী গ্রুপ’-এর জবাবে লিখেছেন। এই কিতাবের মূল বিষয়বস্ত্ত হলো
মির্জা গোলাম আহমদের নবুওত। সেখানে তিনি দাবী করেছেন, মির্জা সাহেব ঐ অর্থে নবী,
যে অর্থে পূর্ববর্তী হযরত মুসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালাম নবী ছিলেন। যেমনিভাবে কোনো
একজন নবীকে অস্বীকারকারী কাফের, তেমনিভাবে মির্জা গোলাম আহমদের নবুওত
অস্বীকারকারীও কাফের।
আশা করি পাঠক বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন
কাদিয়ানী
সম্প্রদায় প্রায় এক শতাব্দী যাবত মুসলিম পরিচয় ব্যবহার করতে যারপরনাই
চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ধোকা, প্রতারণা ও নির্জলা মিথ্যাচারের মাধ্যমে এ
বাস্তবতাকে আড়াল করতে চাচ্ছে যে, ইসলামের নামে তারা একটি নতুন ধর্মমতের অনুসরণ
করছে এবং তার প্রচারণা চালিয়ে সমাজে অশান্তি ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ইতিমধ্যে পৃথিবীর প্রায় সকল মুসলিম রাষ্ট্রে, সরকারীভাবে কাদিয়ানীদেরকে
সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বশেষ ঘোষণা দেওয়া
হয়েছে
পাকিস্তানে। এজন্য তারা বিশেষভাবে আন্তরিক মোবারকবাদ পাওয়ার
যোগ্য। কারণ পাকিস্তানেই হলো কাদিয়ানীদের মূল আস্তানা। ওখান থেকে এ সম্প্রদায়ের
বিশ্বব্যাপী আন্দোলন ও প্রতিপালনের কাজ পরিচালিত হতো। সুতরাং এ-ফেতনার উৎসমুখ
বন্ধ করে দেওয়ার বড় দ্বীনী দায়িত্ব ছিলো
পাকিস্তান সরকারের উপর এবং
বিশ্ববাসী বিশেষত মুসলমানদেরকে জানিয়ে দেওয়া একান্ত কর্তব্য ছিলো যে, ইসলামের
নাম ব্যবহার করে কাদিয়ানী সম্প্রদায় যে মতবাদ প্রচার করছে, প্রকৃতপক্ষে ইসলামের
সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এই নেক কাজে মুসলিম বিশ্ব সংস্থা ‘রাবেতায়ে আলমে
ইসলামী’র অবদানও অনেক বড়। তারা কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবীটাকে
আন্তর্জাতিক দাবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। ফলে পাকিস্তানসহ অন্যান্য মুসলিম
রাষ্ট্রের জন্য এই দাবী আমলে নেওয়া সহজ হয়েছে।
উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে
কাদিয়ানীরা নিজেদেরকে অধিকার-বঞ্চিত ও নির্যাতিত বলে প্রচার করছে এবং
সল্পশিক্ষিত মুসলমানদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, তাদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করাটা
সম্পূর্ণ অন্যায় এবং বাড়াবাড়ি। সরলমনা কিছু মুসলমান তাদের কথা বিশ্বাস করে
পথভ্রষ্টও হচ্ছে। কাজেই যে সমস্ত বুনিয়াদের উপর ভিত্তি করে মুসলিম বিশ্বে
কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলোর মৌলিক কথা সবারই জানা থাকা
দরকার। যাতে এ বিষয়ে কেউ বিভ্রান্তির শিকার না হয়।
প্রথমে তিনটি মৌলিক বিষয় আমাদের বুঝতে হবে।
এক. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে সমস্ত দ্বীনী
বিষয় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে, তার অধিকাংশ বিষয়ের ব্যাপারে যদিও আমরা নিশ্চিন্ত
যে, এগুলি প্রমাণিত ও দলিলসিদ্ধ। সুতরাং বিশ্বাসের বিষয় হলে বিশ্বাসযোগ্য আর আমল
সংক্রান্ত হলে আমলযোগ্য। এতদ্বসত্ত্বেও এগুলোর প্রামাণিক ভিত্তি সব দিক থেকে এ
পরিমাণ দ্ব্যর্থহীন নয়, যার কারণে এগুলির কোনোটি কেউ অমান্য করলে তাকে সরাসরি
নবীজীর শিক্ষা অমান্যকারী বলে সাব্যস্ত করা হবে অথবা তাকে কাফের-মুরতাদ আখ্যা
দেওয়া হবে। দ্বীন ও শরীয়তের অধিকাংশ বিষয় এই ধরনের।
কিন্তু দ্বীনের
অনেক বিষয় এমন আছে, যেগুলো যুগপরস্পরায় এমন অবিচ্ছিন্ন সূত্রে আমাদের নিকট
পৌঁছেছে, যাতে বিন্দুমাত্র সংশয় বা সন্দেহের অবকাশ নেই। যেমন এ বিষয়টি যে, আজ
থেকে চোদ্দশত বছর আগে আরব দেশে ‘মুহাম্মাদ’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এই সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে নবুওত ও রেসালাত দান
করেছেন এবং তিনি সকল মানুষকে দ্বীন ও শরীয়তের প্রতি আহবান করেছেন। তো এটা যেমন
সন্দেহমুক্ত, অকাট্য ও যুগযুগান্তরের পরম সত্য, তেমনি নবীজীর অনেক শিক্ষাও হুবহু
এই পরিমাণ সুনিশ্চিত দলিল দ্বারা প্রমাণিত। যেমন নবীজী ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তথা
তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন, মূর্তিপূজাকে শিরক সাব্যস্ত করেছেন, আল্লাহর কালাম
কোরআন মজীদ মানুষের সামনে পেশ করেছেন ইত্যাদি। এরকমভাবে নবীজী কেয়ামত সংঘটিত
হওয়ার সংবাদ দিয়েছেন, নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ইত্যাদিরও হুকুম দিয়েছেন। এ
ধরনের দ্বীনী বিষয় প্রমাণিত হওয়ার মাঝে সামান্যতম সংশয় বা সন্দেহের অবকাশ নেই।
এগুলি প্রজন্ম পরম্পরায় চলে আসা সুনিশ্চিত এবং অবিসংবাদিত দ্বীনী বিষয়। সব
যুগেই সকল স্তরের মুসলমানের মাঝে এগুলির প্রসিদ্ধি ছিলো, চর্চা অব্যাহত ছিলো।
সুতরাং এ জাতীয় বিষয়- যেগুলিকে ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’ বলা হয়- সেগুলোকে অস্বীকার
করা আর সরাসরি নবীজীর আনীত হেদায়েতকে অস্বীকার করা একই কথা।
দুই. সব
যুগের আলেমগণ কোরআন-সুন্নাহ এবং উম্মতে মুসলিমার নিরবিচ্ছিন্ন কর্মধারা থেকে
ইসলাম ও কুফরের যে অর্থ বুঝে থাকেন, কোনো পাঠকের যদি সে অর্থ জানা থাকে, তাহলে
তিনি দ্বিমত করবেন না যে, মুসলমান হওয়ার জন্য এবং মুসলমান হিসাবে বহাল থাকার
জন্য ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’-এর কোনো বিষয় অস্বীকার না করা শর্ত। যদি এটাও জরুরি না
হয়, তাহলে বলতে হবে মুমিন-মুসলমান হওয়ার জন্য আসলে কোনো কিছুই মান্য করা জরুরি
নয়। আর দ্বীন সম্পর্কে এর চে’ অর্থহীন ও বাজে কথা কিছুই হতে পারে না।
তিন.
ধরুন, -‘জরুরিয়াতে দ্বীন-এর কোনো বিষয় সম্পর্কে একজন বললো, আমি এটা মানি। তবে
অন্যরা যে অর্থে মানে সে অর্থে নয়। যেমন সে বললো, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’- এই
কালিমা আমি বিশ্বাস করি এবং সাক্ষ্য দিই যে, আল্লাহ এক অদ্বিতীয়। তিনি ব্যতীত
কোনো মাবুদ নেই। কিন্তু তোমরা জানো না, আমিই সেই আল্লাহ! আমাকে এখন যে আকৃতিতে
তোমরা দেখতে পাচ্ছো, আমি আল্লাহ সে আকৃতিতেই আবির্ভূত হয়েছি এবং বিদ্যমান আছি।
কুরআন আমারই নাযিলকৃত কিতাব। মুহাম্মাদ আমার প্রেরিত নবী। -পাঠক! এই ব্যক্তিকে
আপনি কাফের বলবেন, না মুমিন? আবার ধরুন, এই লোক নিজের ব্যাপারে উল্লি©র্খত দাবী
করলো না বটে, কিন্তু কোনো মাননীয় ব্যক্তি সম্পর্কে এই দাবী করলো যে,-আল্লাহ বলতে
অমুক ব্যক্তি উদ্দেশ্য। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে বিকৃত মস্তিষ্কের
কিছু লোক এমনটাই ধারণা করতো। তারা বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তাআলা হযরত আলীর আকৃতিতে
আবির্ভূত হয়েছেন! সুধী পাঠক! এদেরকে আপনি কী বলবেন? অথবা মেনে নিন, কেউ বললো,
আমি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ- এই কালিমা বিশ্বাস করি। তবে
সাধারণভাবে এখন পর্যন্ত সকল মুসলমান যে অর্থ বুঝে সে অর্থে নয়। আমার মতে অর্থ
হলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তবে খোদ মুহাম্মদই হলেন সেই আল্লাহ! তিনি
নবীর রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে আগমন করেছেন! কিংবা কেউ বললো, আমি কেয়ামতে বিশ্বাস
করি। তবে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কালের বিশেষ একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি এবং নতুন
যুগের সূচনা। সাধারণ মুসলমানেরা যে মহাপ্রলয় উদ্দেশ্য নিয়ে থাকে তা নয়। এমনটা
কখনো হবে না। অযথাই তারা কেয়ামতের অপেক্ষায় অপেক্ষায় কষ্ট ভুগে চলছে! অথবা কেউ
বললো, কোরআন আল্লাহর কিতাব মানি। কিন্তু এ বিষয়ে আমার ‘খেয়াল’ অন্যদের চে’
ব্যতিক্রম। আমার মতে কুরআন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই রচিত কিতাব।
এটা তাঁরই কালাম। আর তাতে যে বিষয়বস্ত্ত রয়েছে, তা আল্লাহ তাআলার মর্জি মোতাবেক
হওয়ার কারণে কিংবা ঐ বিষয়বস্ত্তগুলো আল্লাহ তাআলা নবীজীর অন্তরে ঢেলে দিয়েছেন
বলে কুরআনকে আল্লাহ তাআলার কিতাব বলা হয়ে থাকে।
এখন চিন্তার বিষয়
হলো, এ ধরনের বিপথগামীদেরকে জরুরিয়াতে দ্বীনের অস্বীকারকারী বলবেন, না বলবেন-
ব্যাখ্যাকারী? যদি ব্যাখ্যাকারী বলেন, তাহলে তারা মুসলমান। আর যদি অস্বীকারকারী
বলেন, তাহলে বলতে হবে, তারা অপব্যাখ্যার অন্তরালে দ্বীনের শ্বাশ্বত এবং
স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কেই অস্বীকার করছে এবং দ্বীন থেকে নিজেদের সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে
ছিন্ন করে ফেলছে।
কথা পরিষ্কার। ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে যারা
জরুরিয়াতে দ্বীন অস্বীকার করে, তাদেরকেও মুমিন-মুসলমান বলার কোনো সুযোগ নেই।
কারণ এমন লোকদেরকে মুসলমান বলার অর্থ প্রকারন্তরে এই দাবী করা যে, জরুরিয়াতে
দ্বীনের সর্ববাদীসম্মত কোনো বাহ্যরূপ বা কল্পরূপ নির্দিষ্ট নেই। সুতরাং পুরো
ইসলাম ধর্মেরই কোনো হাকীকত বা সারবত্ত্বা বলতে কিছু নেই। এ জন্য উম্মতের সকল আলেম
একমত যে, হুকুম ও পরিণামের দিক থেকে জরুরিয়াতে দ্বীনের ভিন্ন ব্যাখ্যা ইসলাম
অস্বীকারেরই নামান্তর।
মনে রাখতে হবে, এটা কোনো শাখাগত মাসআলা নয়,
ছোটখাট গবেষণারও ফসল নয়। বরং এটা ঈমান ও কুফরের সীমানা চিহ্নিত করার একটি
সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতি। আপনি অতীত-বর্তমানের একজন আলেমও দেখাতে পারবেন না, যিনি
এই নীতিতে দ্বিমত পোষণ করেছেন অথবা ব্যাখ্যা-সাপেক্ষে জরুরিয়াতে দ্বীনের
অস্বীকারকে কুফর বলতে তিনি রাজি নন। অবশ্য কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের উপর এই
নীতি প্রযোজ্য হবে কি হবে না, হলে কতটুকু হবে, যে আলেম কোনো ব্যক্তি বা
সম্প্রদায়ের উপর এই নীতি প্রয়োগ করবেন, তাদের বিষয়ে ঐ আলেমের জানাশোনার পরিমান
কতটুকু? -এ সকল বিবেচনায় কিছু কিছু মতপার্থক্য হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য মূলনীতির
বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। অর্থাৎ জরুরিয়াতে দ্বীন অস্বীকার করা- যদিও তা
ব্যাখ্যা সাপেক্ষে হয়ে থাকে, তবু তা কুফর, নিঃসন্দেহে কুফর।
আপনি যদি প্রতিটি নতুন বই সবার আগে পেতে চান, তাহলে আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপের
সাথে যুক্ত থাকুন 👉👉
Join করুন
ডাউনলোড